গারো সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষক জেসি ডেইজি

বেকার জীবনবেকার জীবন
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  05:59 AM, 06 October 2022

টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার ভুটিয়া গ্রামে বাড়ি তাঁর। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়।শৈশব থেকে ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন ডেইজি। অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুল বৃত্তি পেয়েছেনবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ছিলেন।নেত্রকোনার বিরিশিরি মিশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ঢাকার হলি ক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন।এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তিযুদ্ধ, কিন্তু কপাল মন্দ ডেইজির। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় অপেক্ষমাণ তালিকায় ছিলেন। শেষমেশ ২০০৫-০৬ সেশনে ভর্তি হতে হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে।

হতে হলো বলছি, কারণ মেডিক্যালে ভর্তি হতে না পারার কষ্ট নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুরু করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পর ডেইজির মনে হলো, মেডিক্যালে ভর্তি হতে না পারা শাপেবর হয়েছে তাঁর জন্য। তত দিনে শিক্ষকরাও ছিপছিপে গড়নের এই তরুণীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করতেন। স্যারদের নির্দেশনা অনুসরণের চেষ্টা করতেন। তখন তিনি প্রথম বর্ষের ছাত্রী। প্রথমবারের মতো প্রথম বর্ষের সবাইকে একটি অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলেন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সালমা নাসরিন। সবাইকে চমকে দিয়ে সেই অ্যাসাইনমেন্টে ‘ডাবল এ প্লাস’ পেয়েছিলেন ডেইজি। ক্লাসে ডেইজির করা অ্যাসাইনমেন্টের খাতা দেখিয়ে অধ্যাপক নাসরিন বলেছিলেন, ‘এই অ্যাসাইনমেন্ট এত ভালো হয়েছে যে আমি শুধু এ প্লাস দিয়ে তুষ্ট হতে পারছি না, দিলাম এ ডাবল প্লাস। ’

অধ্যাপক জীনাত ইমতিয়াজ আলী ‘ফোনেটিকস অ্যান্ড ফোনোলজি’ পড়াতেন। তাঁকে ভীষণ ভয় পেত ক্লাসের সবাই। পড়া না পারলে ক্লাসে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। ফলে প্রায় সবাই চেষ্টা করত অন্তত তাঁর ক্লাসের পড়া শেষ করে যেতে। একদিন জীনাত ইমতিয়াজ আলী ক্লাসে ডেইজিকে বললেন, ‘আশা করি, তুমি পারবে।

তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। এই দুটি ঘটনা ভীষণ অনুপ্রাণিত করল ডেইজিকে। বিভাগের ক্লাস শেষ করে এসে সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে ঢুকে যেতেন। ডুবে থাকতেন বইয়ের রাজ্যে। এভাবেই অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট থেকে স্প্যানিশ ও জার্মান ভাষাও শিখেছিলেন।

ভাষাবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষেই ৩৩তম বিসিএসের সার্কুলার হলো। ডেইজিও আবেদন করলেন। প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার বৈতরণী পার হলেন সফলভাবে। এবার অপেক্ষা চূড়ান্ত ফলের জন্য। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক নেবে বলে একটি সার্কুলার হলো। যথারীতি সেখানেও আবেদন করলেন। মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার চিঠিও পেলেন।

সেটিও উতরে গেলেন ভালোভাবেই। বেশ কিছুদিন পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি চিঠি এলো ডেইজির ঠিকানায়। চিঠির খাম খুলে তো ডেইজির আনন্দ যেন আর ধরে না! ‘অভিনন্দন’ জানিয়ে সেই চিঠিতে লেখা ছিল, ‘আপনি ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগের জন্য প্রাথমিকভাবে মনোনীত হয়েছেন। ’

এর মধ্য দিয়ে আসলে তৈরি হলো নতুন ইতিহাস। বাংলাদেশে ডেইজির আগে গারোদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক ছিলেন না। এই প্রথম গারো সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেন। ব্যাপারটি ভীষণ গর্বের বলে মনে করেন ডেইজি। বললেন, ‘যোগদান করার আগে এটা জানতাম না, কিন্তু পরে যখন লোকে একে একে অভিনন্দন জানানো শুরু করল, তখন ভালোই লাগছিল। মা মিনু হাজং শিক্ষক ছিলেন। মায়ের বাবা শিক্ষক, মামা-খালারাও শিক্ষক। বাবার ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল শিক্ষকতা দিয়ে। এমনকি আমার বোনও শিক্ষক। আমিও পারিবারিক পেশার বাইরে যেতে পারলাম না। ’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন ২০১৩ সালে। শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস চারেক পার করার পর ৩৩তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হলো। সেখানে প্রশাসন ক্যাডারে চাকরির সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন ডেউজি। মা-বাবাসহ স্বজনদের সবাই ডেইজিকে অনুরোধ করল, যেন প্রশাসনে যোগ দেন। কিন্তু স্বজনদের এক রকম হতাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবেন বলেই স্থির করলেন।

বললেন, ‘প্রশাসনে যোগদান করলে হয়তো তরতর করে ওপরে ওঠা যেত, কিন্তু সহজ-সরল জীবন থেকে দূরে সরে যেতে হতো আমাকে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়েই রয়ে গেলাম। ’ তাঁর বাবা মধুনাথ সাংমা বলেন, ‘গারো সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রশাসনে নারীদের কেউ ছিল না। তাই ওকে প্রশাসনে যোগ দিতে বলেছিলাম, কিন্তু মেয়ে শিক্ষকতা ছাড়তে চাইল না। ’এত দিন মারমা ভাষার বৈচিত্র্য, জীবনযাপনে এর প্রভাব এবং ভাষাটি সংরক্ষণ বিষয়ে কাজ করেছেন। কিছুদিন আগেই পদোন্নতি পেয়ে সহকারী অধ্যাপক হয়েছেন ডেইজি। ভবিষ্যতে মান্দি ভাষা নিয়ে গবেষণা করতে চান তিনি।

সূত্রঃ কালের কন্ঠ

আপনার মতামত লিখুন :