ফোকাস রাইটিংঃ করোনা মোকাবেলায় ব্যাংক/কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা

কোনো বড় ধরনের সংকটে দেশের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের জন্য ব্যাংকিং খাতের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারি যখন বাংলাদেশের অর্থনীতিকেও ভগ্নপ্রায় করে তুলেছে, তখন এই সংকট উত্তরণের অনুঘটক হিসেবে বন্ধপ্রায় অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গতি ফেরাতে এবং আয় হারানো মানুষের মাঝে তারল্য প্রবাহ সঞ্চারণের জন্য ব্যাংকিং খাতের অংশগ্রহণ অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে কয়েক লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হবে। যদিও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা কম। কিন্তু আক্রান্তের তুলনায় মৃতের হার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি।
যেকোনো মহামারির দুটি পর্যায় রয়েছে, প্রথমটি হচ্ছে স্বাস্থ্যগত বিপর্যয় এবং দ্বিতীয়টি অর্থনৈতিক বিপর্যয়। বিশ্বের সবগুলো দেশই এই মুহূর্তে স্বাস্থ্যকে মূল প্রাধান্য দিয়ে অর্থনীতিকে সচল রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ধাক্কা সামনের দিনগুলোতে অপেক্ষা করছে।২০০৮-০৯ সালের বৈশ্বিক মন্দার কারণ ছিল ব্যাংক এবং রিয়েল স্টেট কোম্পানিগুলোর যোগসাজশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার ফাঁকফোকরকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকা, ইউরোপের বড় বড় ব্যাংক সে সময়ে যাচাই–বাছাই না করে রিয়েল স্টেটে লোন দিয়েছে। তেমনিভাবে অন্যান্য মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোও তাদের ব্যবস্থাপকদের বিশাল অঙ্কের বোনাস, কমিশন এবং পে চেক দিয়েছে, ফলে সারা বিশ্বেই একরকম একটি কৃত্রিম তারল্য সংকট তৈরি হয়েছিল।বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন ধুঁকছিল, তখন বাংলাদেশের অর্থনীতি মোটামুটি সুরক্ষিত ছিল। এই সুরক্ষার রক্ষাকবচ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া মুদ্রানীতির মধ্যে অন্যতম ছিল তারল্য সরবরাহ সঠিক রাখা এবং সুদের হার কমিয়ে অর্থনৈতিক কার্যক্রম সচল রাখা।
বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। সরকার ব্যাংকগুলোতে সুদের হার ৯ শতাংশে নির্ধারণ করেছে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে; তার ফলে ব্যাংকগুলো অনেক টাকার মুনাফা হারাবে।এই পরিস্থিতিতে ব্যাংকারদের ধারণা, ছোট ছোট ব্যাংকগুলো গড়ে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা এবং বড় ব্যাংকগুলো ১৫০ থেকে ২০০ কোটি টাকা লোকসান দেবে চলতি বছরে।বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গেল সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এর তিন মাস আগে (গত জুন শেষে) মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা বেড়েছে।ইতোমধ্যে ১৩ টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি কমেছে (১)-গ্রাফ (কমেন্ট)
এসব বিবেচনায়,গত ৩০ এপ্রিল এডিবি বাংলাদেশকে ১০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করে। নতুন করে এই ৫০০ মিলিয়ন ডলারের অনুমোদনের পর এখন মোট ৬০২ মিলিয়ন ডলারেরও বেশী ঋণ অনুমোদন করল সংস্থাটি(২)।এছাড়া (করোনা ভাইরাস)-এর কারণে সৃষ্ট সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশকে ১০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে বিশ্ব ব্যাংক(৩)এহেন পরিস্থিতি সত্ত্বেও কেন্দ্রিয়ব্যাংক সহ অন্যান্য ব্যাংক গুলোকে বিভিন্ন অবস্থা পর্যালোচনা করে তাতের কার্যক্রম চালাতে হবেঃ
১.গ্রাহক চেনা, তার ব্যবসা চেনা, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ের ক্ষতি নিরূপণ করা, কি পরিমাণ টাকা তার এই আপদকালিন সময়ে লাগবে, সেটা নিরূপন করা, সিআইবি সংগ্রহ করা, ক্রেডিট রিপোর্ট দেখা, জমি/সিকিউরিটির মূল্যায়ন করা ইত্যাদির ভিত্তিতে ঋণ প্রদান করা।২. বাংলাদেশ ব্যাংক তার সিআরআর ৫.৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ কমিয়ে এনেছে, রিপো রেট .২৫ শতাংশ কমিয়েছে। এইধারা অব্যহত রাখতে হবে।
৩.পাশাপাশি কৃষি এবং ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের জন্য সরকার প্রণোদনা বা সহজ ঋণের ঘোষণা করেছে, যেটির বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ভূমিকা পালন করতে হবে।৪.যদি রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্সের ধারা আগামী কয়েক মাস নিম্নমুখী থাকে, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংককে বন্ড ইস্যুর কথা ভাবতে হবে।৫. যদি তাতেও সংকট না কমে, তাহলে সবশেষ পদক্ষেপ হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতায় মুদ্রা ছাপিয়ে দেশের মুদ্রা সরবরাহকে সচল রাখা৬.ব্যাংকগুলোকে অনলাইন নির্ভরতা বাড়িয়ে ক্যাশ নির্ভরতা কমাতে হবে করোনা মহামারি ছড়ানো হ্রাস করতে।
উপরোক্ত বিষয়াদি বিবেচনায় ব্যাংকগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।করোনার কারণে একদিকে মানুষের জীবনের প্রশ্ন আরেক দিকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি। প্রতিটি দেশ এই অবস্থার ভুক্তভোগী এবং এখনকার অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। আর্থিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ নয় বরং সঠিক অর্থনৈতিক সমন্বয় হবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশ ব্যাংক যেমনভাবে ২০০৮-০৯–এর পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে, তাতে এই প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য নিয়ে কারও প্রশ্ন নেই। কিন্তু যথাযথ নেতৃত্ব, সরকারসহ ব্যক্তি এবং ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে সেতুবন্ধ সৃষ্টি করে কীভাবে এই ব্যাংক আগামী কয়েক মাসের অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে, সেটির ওপরই আগামী অন্তত দুবছরের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেবে। লিখেছেনঃLatifur Rahman Liton রেফারেন্সঃ প্রথম আলো,১০ জুলাই,২০২০ (১),এডিবি রিপোর্ট,মে, ২০২০ (২),বিশ্বব্যাংক রিপোর্ট,জুন, ২০২০ (৩)