“বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকটঃ- কারন ও প্রতিকার”

বেকার জীবনবেকার জীবন
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  01:47 AM, 29 July 2020

তারল্য হল ব্যাংকের স্বল্প কালিনে অর্থ পরিশোধ করার ক্ষমতা। তারল্য সংকট বলতে আমরা বুঝি – কোন কারণে গ্রাহক যদি ব্যাংকের নিকট টাকা চেয়ে না পান তখন তারল্য সংকট পরিলক্ষিত হয় অর্থাৎ গ্রাহকের চাহিদা মেটানোর মত টাকা ব্যাংকে জমা না থাকার মত অবস্থাকে তারল্য সংকট বলে।তারল্য সংকট বর্তমানে আমাদের দেশে প্রকট আকার ধারণ করেছে।বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংকগুলো নাজেহাল অবস্থায়, চলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ সুদে ঋণ বরাদ্দ নিয়ে।গ্রাহক ব্যাংকের নিকট গিয়ে তার চাহিদা মত টাকা লেনদেন করতে পারছে না।বিশেষকরে যারা ঋণ নিতে চায় তারা তাদের প্রয়োজনীয় ঋণ পাচ্ছে না। এই অবস্থা বেশ কিছু দিন ধরেই বিরাজমান। কোন ভাবেই এর উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং করোনা মহামারীতে দিন কে দিন এই অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে ব্যাংকের তথ্যমতে,সার্বিকভাবে ব্যাংকখাতের উদ্ধৃত তারল্য কমছে।আবার, তারল্যের উপর চাপের কারণে সুদহার কমানো যাচ্ছে না।একদিকে যেমন আমানতে সুদের হার বেশি গুনতে হচ্ছে,অন্যদিকে ঋণ আদায় বাড়ানো যাচ্ছে না।গত মাসের তথ্যমতে মাত্র ১২ টি ব্যাংকে তহবিল আছে ঋণ দেবার মত,বাকি ব্যাংক গুলো চলছে ধার করে।বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে প্রয়োজনীয় ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণে (সিএআর) ব্যর্থ হয়েছে ১২ ব্যাংক। ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এ সময় ব্যাংকিং খাতে সামগ্রিক মূলধন পর্যাপ্ততার হার (সিআরএআর) সামান্য হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আগের প্রান্তিক সেপ্টেম্বর শেষে ১২ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ১৭ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা।

এই বার আসা যাক তারল্য সংকট কেন হচ্ছে তার কিছু কারন। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির আলোকে তারল্য সংকটের কিছু কারন উল্লেখ করা হলোঃ১. সরকারী ঋণ: বর্তমানে বিভিন্ন কারণে সরকার ব্যাংকগুলি থেকে অতিরিক্ত ঋণ নিচ্ছে, ফলস্বরূপ ব্যাংকগুলি চরম তরলতার সংকটে রয়েছে।২. শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ: অল্প সময়ে বেশি লাভের আশায় অনেকে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রচুর পরিমাণে অর্থ সংগ্রহ করে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেছে।শেয়ারবাজারের ক্রমাগত ধ্বসে অনেকে অাত্নহত্যা করায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে,যার কারণে তারল্য সংকট চরমে।

৩. আমানতকারীদের অবিশ্বস্ততা: ব্যাংকিং খাতে বেশ কয়েকটি বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি জনগণের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করেছে। এখন অনেক লোক ব্যাংকে টাকা রাখার চেয়ে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগে বেশি আগ্রহী। এসব কারণে ব্যাংকিং খাতে তরলতার সংকট তৈরি হয়েছে।৪. ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো:এক সমীক্ষণ থেকে দেখা গেছে যে এক ধরণের ব্যবসায়ী খেলাপিদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থেকে নিরাপদে থাকার ভয়ে আগে তিন মাসের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতেন। কিন্তু এখন খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তিত হওয়ায় ব্যবসায়ীরা ৯ মাস পাচ্ছেন। অন্য কথায়, এখন ব্যবসায়ীরা ৯ মাস ঋণ পরিশোধ না করেই খেলাপি থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন। ফলস্বরূপ, তিন মাসের শেষে যারা ঋণ শোধ করতো তারা এখন ৯ মাসের শেষে ঋণ পরিশোধ করছে। এটি ব্যাংকে নগদ প্রবাহকে বাধা দিচ্ছে।

৫. মেগাপ্রজেক্টে বিনিয়োগ: মেগা অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলির চলমান বাস্তবায়ন নগদ ঘাটতি বাড়িয়ে তোলে। কারণ ঋণদানকারীরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কেনার মাধ্যমে এগুলি বাস্তবায়নের জন্য আমদানি অর্থায়ন সরবরাহ করে চলেছে।৬. বৈদেশিক মুদ্রার পরিমান কমে যাওয়াঃ বেশ কিছু দিন ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে আমাদের দেশে রেমিটেন্স প্রবাহ কমে গেছে। কারন বিদেশ থেকে কর্মী প্রেরন ও কর্মী না নেয়া বিভিন্ন কারনে রেমিটেন্স প্রবাহ কমে গেছে। করোনা পরিস্থিতির কারনে এই তারল্য সংকট আর প্রকট আকার ধারন করেছে।৭.দেশে বিদ্যমান উচ্চহারে মুদ্রাস্ফীতি: মুদ্রাস্ফীতি এটি আরেকটি অন্যতম প্রধান কারন। মুদ্রাস্ফীতির কারনে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। মানুষ উচ্চ মূলে জিনিসপত্র কিনতে হচ্ছে, ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে ব্যাংককে পূর্বের সঞ্চয়ের টাকা তুলে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছে।

তারল্য সংকট সমাধানে ব্যাংকগুলো অনেক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।তারল্য সংকট সমাধানের উপায় ও করণীয়:১.সর্বপ্রথম আইন পরিবর্তন করা,কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন।২.খেলাপি ঋণ আদায়ে অর্থ ঋণ আদালতকে প্রভাবমুক্ত ও কার্যকর করা।৩.খেলাপিঋণ গ্রহীতার সাথে সমঝোতার মাধ্যমে বিতরণকৃত ঋণ আদায়ে সচেষ্ট হওয়া।৪.ঋণ প্রদানেরপূর্বে যথাযথ মনিটরিং৫.অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের প্রবৃত্তি ত্যাগ করা।৬.দক্ষ জনবল নিয়োগ করা।৭.বাংলাদেশ ব্যাংক এর নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করা।৮.সরকারের অতিমাত্রায় ঋণ গ্রহন বন্ধ করা।৯.দেশের বাহিরে টাকা পাচার বন্ধ করা।১০.বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান তারল্য সংকটের প্রকৃত কারন অনুসন্ধান করে এর সমাধানের উপায় খুজে বের করা খুবই জরুরি। সেই সাথে ভবিষ্যতে এমন সংকট সৃষ্টি হতে না পারে তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এখনি নেয়া জরুরি।যার, ফলে সমৃদ্ধ হবে ব্যাংকের তারল্য,সম্ভাবনায় ভরে উঠবে বাংলাদেশের অর্থনীতি।লিখেছেনঃ Latifur Rahman Liton

আপনার মতামত লিখুন :